Tuesday, May 3, 2016

আশরাফ আলী (রহ.) তাবলিগী যুক্তি



                     তাবলিগের মুরুব্বি- ০৭ :  হজরত মাওলানা আশরাফ আলী (রহ.)


চমত্কার ভাবে যুক্তিপূর্ণ ভাষায় বয়ান করতেন মাওলানা আশরাফ আলী রহ.। অহেতুক কোনো যুক্তি দেখিয়ে তাঁর কাছে থেকে পাড় পাওয়া যেতো না। জামাতে থাকা অবস্থায় এক সরকারি অফিসাকে দাওয়াত দিতে গেলেন একবার। অফিসার তাকে দেখে বললো,
রে ভাই সবার জন্য সব কাজ নয়। আপনাদের কোনো কাজ নেই তাই আপনারা তাবলীগ করেন। আমার অনেক কাজ আছে, তাই আমি তাবলীগ করতে পারি না। সবাই কি সব কাজ করতে পারে? কাজের মধ্যে ভাগাভাগি আছে না? আপনারা তাবলীগ করেন আর আমি অফিস করি।’ 

তিনি তখন বললেন, ‘আচ্ছা আপনি বুঝি ঘরের কাজেও এভাবে ভাগাভাগি করেন?’ লোকটি বললো, ‘মানে?’ হুজুর তখন বললেন, ‘আপনি শুধু খানা খান আর আপনার বিবি শুধু পায়খানা করে। আপনার ছেলে শুধু পড়াশুনা করে আর আপনার মেয়ে শুধু ঘুমায় ব্যাপারটা কি এমন?’ অফিসার বললো, ‘না এসব কাজ কি ভাগ করে করা যায়?’ 

মাওলানা আশরাফ আলী তখন বললেন, ‘তাবলীগও এমন একটি কাজ যা ভাগ করা যায় না। এটা সবার কাজ। সবারই এ কাজ করতে হবে।মাওলানা সাহেবের যুক্তিপূর্ণ কথা শুনে অবশেষে লোক তাবলীগে গেলেন এবং মাওলানাকে তার ভুল সুধরে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানালেন।বাংলাদেশ তাবলীগ জামাতের একজন স্বনামধন্য মুরুব্বী ছিলেন মাওলানা আশরাফ আলী রহ.।

মাওলানা আব্দুল আজিজ রহ. দেশের বাহিরে সফরে গেলে তাঁর ওপর দায়িত্ব রেখে যেতেন। মাওলানা আব্দুল আজিজের ইনতিকালের পর মাওলানা আশরাফ আলীই কাকরাইলের প্রধান মুরুব্বী হিসেবে স্থলাভিষিক্ত হন এবং তাঁর ইনতিকাল পর্যন্ত অন্যন্ত ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২৩ মতান্তরে ২৪ সালে মোমেনশাহী জেলার গফরগাও থানাধীন কাজানামক গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন মাওলানা আশরাফ আলী। তাঁর পিতার নাম ছিল শেখ ইদরিস আলী। দুই ভাইয়ের মাঝে তিনি ছিলেন বড়। প্রাথমিক স্কুল জীবন সমাপ্ত করার পর কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া থানাধীন তারাকান্দি মাদরাসায় এসে ভর্তি হন তিনি এবং খুব সুনামের সঙ্গে কয়েক বছর পড়াশুনা করেন সেখানে। এরপর চলে আসেন গফরগাওয়ের বিখ্যাত বুযূর্গ মাওলানা পাঁচবাগীর রহ. মাদরাসায়।

এই মাদরাসায় পড়াকালীন মাওলানা পাঁচবাগীর সঙ্গে তাঁর আধ্যাত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরপর তাঁরই পরামর্শে ঢাকাস্থ বড় কাটারা মাদরাসায় ভর্তি হন এবং সুনামের সঙ্গে দাওয়ারে হাদিস সমাপ্ত করেন। দাওয়ারে হাদিস সমাপ্ত করার সঙ্গে সঙ্গে গফরগাও মাঝবাড়ি আলিয়া মাদরাসায় চাকুরী হয় মাওলানা আশরাফ আলীর। মাদরাসায় শিক্ষক ও গফরগাও সতেরবাড়ি জামে মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি জুরির হাকিম এবং ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বরও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।

১৯৬৭ কিংবা ৬৮ সালের কথা। এলাকায় মসজিদে আসা তাবলীগ জামাত সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে এসে মুগ্ধ হয়ে জামাতে বের হলেন মাওলানা আশরাফ আলী। এবং কেবল বেরই হলেন না ধীরে ধীরে তাবলীগ জামাতের একনিষ্ঠ একজন কর্মী বনে গেলেন। খোদার কবুলিয়াত এবং লাখো মানুষের ভালোবাসা নিয়ে সর্বজন শ্রদ্ধেয় তাবলীগী মুরুব্বীর শান অর্জন করলেন এক সময়।

ইসলামি দাওয়াতি কাফেলার অন্যতম সদস্য এই মনীষী দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন গোটা বিশ্বময়। মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন নবিজীর সা. বাণী। ব্যক্তিগতভাবে খুব সাদামাটা জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন মাওলানা আশরাফ আলী। অনাড়ম্বপূর্ণ নবিজীর সা. আদর্শব্যপ্ত একটি জীবনের মালিক ছিলেন তিনি। তাঁর এক শুভাকাক্ষী বাড়িতে বিল্ডিং করে দেওয়ার প্রস্তাব দিলে হুজুর তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘এই দুনিয়া আরামের জায়গা নয়।

তাবলীগের সফরে ঘুরে ঘুরে সৌদি আরবে থাকাকালীন জন্ডিস রোগে আক্রন্ত হন তিনি। চিকিত্সার জন্য বাদশাহ ফাহাদ ক্লিনিকে ভর্তি করা হলে কিছুটা সুস্থতা লাভ করেন এবং বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এখানে আসার পর আবার অসুস্থ হয়ে পরেন। অসুস্থ হওয়া বা রোগবালাই ছিল বাহানা মাত্র, বস্তুত প্রিয়তম প্রভুর দরবার থেকে তাঁর ডাক এসেছিল। 

মহান মালিকের সান্নিধ্য লাভের স্পৃহায় আরো বেশি উতলা হয়ে উঠেছিলেন মাওলানা আশরাফ। এবং তাই হলো ১৯৯৭ সালের মে মাসে ইহলোকের আলো আঁধার আর হাসি কান্নাকে বিদায় জানিয়ে প্রিয়তম প্রভুর সাক্ষাৎপ্রর্থীদের মিছিলে লাব্বাইকবলে চলেন গেলেন তিনি, ইহলৌকিক বিদায় নিলেন মাওলানা আলী। (ইন্নানিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)  মাওলানা মিরাজ রহমান




No comments:

Post a Comment